জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে আরো একবার কাঁদল টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়ার মানুষ। গোপালগঞ্জে তাঁর জন্মভূমিতে নেমেছিল শোকের মিছিল। ৪৬ বছর আগের দুঃসহ সেই কালরাতের ঘটনা স্মরণ করেছে স্থানীয়রা। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শোকের কালো চাদরে ঢেকে যায় দুই উপজেলার সর্বত্র। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার যেতে না পারলেও টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।

দিনভর নানা কর্মসূচির মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, প্রতিটি গ্রামে কাঙালি ভোজ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনাসভা। গতকাল রবিবার সকাল ৬টায় দলীয় কার্যালয়ে জাতীয়, দলীয় ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান কর্মসূচি। এরপর দুপুর ২টায় কোটালীপাড়া ও টুঙ্গিপাড়ার বিভিন্ন স্থানে কাঙালি ভোজের আয়োজন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে টাঙানো হয় কালো পতাকা। জেলার বিভিন্ন সড়কে কালো কাপড় দিয়ে তৈরি তোরণে সৃষ্টি হয় শোকের আবহ।

জেলার সব মসজিদ, মন্দির, গির্জায় জাতির পিতার আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিন জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে টুঙ্গিপাড়া এসে থাকেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর তিনি জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসতে পারেননি।

সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তিন বাহিনীর পক্ষে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষে লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতারা বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শ্রদ্ধা জানান।

এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান এমপি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম এমপি, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এস এম কামাল হোসেন, আনিছুর রহমান, সাহাবুদ্দিন ফরাজী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এরপর জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, টুঙ্গিপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডসহ শতাধিক সংগঠনের পক্ষে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

পরে সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মিলাদ মাহফিলে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা যোগ দেন। এরপর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে শ্রদ্ধা জানাতে সৌধ কমপ্লেক্স উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমরা আশা করি, আমেরিকায় পালিয়ে থাকা একজনকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে পারব। অন্য তিনজনের খবর আমরা জানি না, যারা বিদেশে পালিয়ে আছে।’

তিনি সব প্রবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেউ যদি বাকি তিনজনের খোঁজ দিতে পারেন, তাহলে তাঁদের পুরস্কৃত করা হবে। তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অনেকেই খুনিদের মদদ দিয়ে গেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাদ জোহর টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স মসজিদসহ টুঙ্গিপাড়ার সব মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। মিলাদের তবারক হিসেবে চার হাজার প্যাকেট বিরিয়ানি বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. ইলিয়াছুর রহমান।

কোটালীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ : উপজেলার প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, গ্রামে গ্রামে, এমনকি উপজেলার বাড়িতে বাড়িতে ১৫ আগস্টের শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। শোক দিবস উপলক্ষে কুশলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম বাদলের পক্ষ থেকে চৌরখুলী গ্রামে ‘অবলম্বন’ পুনর্বাসনকেন্দ্রের শ্রমিকদের মাঝে উন্নত মানের খাবার বিতরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন এখানকার শ্রমিকেরাও। বৃদ্ধা ডালিম বেগম বলেন, ‘আমাগো শেখ সাব খুব ভালো মানুষ ছিল।

ওরা তারে বাঁচতে দিল না। আজকের এই দিনে ওই শয়তানরা আমাগো শেখ সাবরে মাইরগা হ্যালাইছে। আল্লাহ য্যান শেখ সাবরে জান্নাতবাসী করে।’ সত্তরোর্ধ্ব লুত্ফা বেগম, আনোয়ারা বেগম, সেতারা বেগমরাও বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করেন। শোক দিবস উপলক্ষে কোটালীপাড়ার বিভিন্ন স্থানে কাঙালি ভোজের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৯৯টি স্থানে আলোচনাসভা, দোয়া মাহফিল ও দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া দেবগ্রাম আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের দেওয়া হয় উন্নত মানের খাবার।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস ওয়াহিদ আশ্রয়ণ প্রকল্পে উন্নত মানের খাবার বিতরণ করেন। কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হোসেন শেখ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কোটালীপাড়াবাসীর নয়নের মণি ছিলেন। আমরা আজও পঁচাত্তরের কালরাতের ঘটনা মানতে পারি না।’ কুশলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম বাদল বলেন, জাতির পিতার স্মৃতিবিজড়িত গোপালঞ্জের এই কোটালীপাড়া। রাজনৈতিক জীবনের অনেকটা সময় বঙ্গবন্ধু কাটিয়েছেন এখানে।

হেঁটে ও নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামে। অবস্থান করেছেন অনেক নেতার বাড়িতে। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ভবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম হুমায়ুন কবির, পৌর মেয়র হাজি মো. কামাল হোসেন শেখ, সাবেক পৌর মেয়র এইচ এম অহিদুল ইসলাম, ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া দাড়িয়া, হান্নান শেখ, খোকন বালা, অমৃত লাল হালদার, মাইকেল ওঝা।

উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান হাজরা, জেলা পরিষদ সদস্য দেবদুলাল বসু পল্টু, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিটুল রায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রাশেদুর রহমান, সমাজসেবা কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান শুভ, নির্বাচন কর্মকর্তা খায়রুল হাসান, উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার জসিম উদ্দিন শেখ, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক বাবলু হাজরা, শুয়াগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যজ্ঞেশ্বর বৈদ্য অনুপসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।